আইনে বাধ্যবাধকতা থাকিলেও অবাক করা বিষয় হইল, উপাচার্য ছাড়াই চলিতেছে বর্তমানে দেশের ২৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় চলিতেছে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ—এই তিনটি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ছাড়া। গত বত্সরে পত্রিকান্তরের এক প্রতিবেদনে দেখা গিয়াছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ৭৪টিতে প্রো-ভিসি নাই, আর কোষাধ্যক্ষ ছাড়াই চলিতেছে ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন ভিসি, প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, একাডেমিক কমিটি, অর্থ কমিটি ও শৃঙ্খলা কমিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ সকল কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করিতে হয় ভিসিকে। তাহার মাধ্যমেই এইসকল কমিটির সদস্য মনোনয়ন, ডিন, বিভাগীয় প্রধান নিয়োগদানের বিধান রহিয়াছে। কিন্তু যাহাদের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হইবে সেই শীর্ষ পদগুলিই যদি দীর্ঘসময় ফাঁকা থাকে তাহা হইলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠিবে, কীভাবে পরিচালিত হইতেছে এইসকল বিশ্ববিদ্যালয়!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী উপাচার্য হইলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের সনদে স্বাক্ষর করিবার বাধ্যবাধকতা রহিয়াছে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত উপাচার্যের; কিন্তু উপাচার্য না থাকায় এইসকল বিশ্ববিদ্যালয় হইতে উত্তীর্ণরা মূল সনদ নিতে গিয়া বিপাকে পড়িতেছেন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ড নিয়োগকৃত অস্থায়ী উপাচার্য মূল সনদে স্বাক্ষর করিতেছেন—যাহা আইনের পরিপন্থী। গত বত্সরের নভেম্বরে ইউজিসি বিজ্ঞপ্তি জারি করিয়াছিল যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অর্জিত ডিগ্রির মূল সনদ উপাচার্য এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দ্বারা স্বাক্ষরিত হইতে হইবে। রাষ্ট্রপতির নিয়োগকৃত উপাচার্যের স্বাক্ষর ছাড়া সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য নহে। আর, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুসারে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার পদে পূর্ণকালীন নিয়োগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু তাহা অনেকেই মানিতেছে না। অনেকেই মনে করেন, শিক্ষাদান নহে, মুনাফার জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালনা ব্যয় কমাইতে শীর্ষ পদগুলি ফাঁকা রাখিতেছে। মালিকপক্ষ শীর্ষ পদগুলো খালি রাখিয়া জোড়াতালি দিয়া কার্যক্রম পরিচালনা করিতেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলিকে পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারে ব্যবহার করা হইতেছে। এইসকল পদে কাউকে নিয়োগদান না করায় থাকিতেছে না জবাবদিহিতা, উচ্চশিক্ষার মান গিয়া ঠেকিয়াছে তলানিতে। আর, ট্রেজারার না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও উঠিতেছে প্রতিনিয়তই। তদুপরি, সুনির্দিষ্ট নিয়োগবিধি না থাকায় স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিয়াছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইচ্ছামতো নিয়োগদান, চাকুরীচ্যুতিসহ নানা অনিয়ম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বাড়িয়াই চলিয়াছে।
বর্তমানে দেশে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রহিয়াছে। ইহার মধ্যে ৮৮টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলিতেছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা নিতেছেন এমন ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই পড়িতেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। ইতোপূর্বে সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, এইগুলির মধ্যে মাত্র গোটা দশেকের মান ভালো, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান মোটামুটি চলনসই। আর বাকিগুলি একেবারেই মানহীন। তাই নিঃসন্দেহেই বলা যায়, কেবলই ক্ষমতার দাপট আর মুনাফার ঝনঝনানি উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে এইভাবে নতজানু করিয়া ফেলিয়াছে। যখন ইউজিসির চেয়ারম্যানও অসহায়ের মতো স্বীকার করেন যে, এইসকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইনকে অনায়াসে থোড়াই কেয়ার করেন, তখন তাহার অসহায়ত্ব বোঝা যায়। বর্তমান প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় উচ্চশিক্ষার নামে এইরূপ অনাচার কোনোভাবেই মানিয়া নেওয়া যায় না।
Desing & Developed BY EngineerBD.Net
Leave a Reply